বিশেষ সংবাদদাতা: শহরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সড়ক হলো দেওভোগের আলী আহাম্মদ চুনকা সড়ক। নারায়ণগঞ্জ ডায়বেটিক হাসপাতালসহ আরও বেশ কয়েকটি স্বাস্থ্য ক্লিনিকের প্রধান সড়ক এটি। এছাড়া কাশিপুর, বক্তাবলী ও মুন্সীগঞ্জ জেলাসহ ফতুল্লার বিসিক শিল্পনগরীতে যাতায়াতের সহজ পথ হওয়ায় এ সড়ক দিয়েই প্রতিদিন প্রায় লক্ষ লক্ষ সাধারন মানুষ ও গার্মেন্টস কর্মীরা চলাচল করে থাকে। ফলে এ সড়কের ব্যস্ততা অন্যান্য সড়কের তুলনায় কিছুটা বেশি। প্রতিদিন এ সড়কে সদর ও ফতুল্লা ছাড়াও মুন্সীগঞ্জ জেলার প্রায় শত শত অটো রিকশা, মিশুক ও বিভিন্ন যানবাহনের দেখা মিলে।
যানবাহনের চাপ বেশি থাকার কারণে একটা সময় দিনের বেশির ভাগ সময়ই এ সড়কে যানজট লেগে থাকতেই দেখা যেতো। আর এ যানজটের জন্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হতো হাসপাতালের যাত্রী, গার্মেন্টস কর্মী ও চাকুরী জীবীরা। যানজটের কারণে সময়মত কর্মস্থলে পৌছতে না পেরে অনেক শ্রমিক ও চাকুরী জীবীকে তাদের চাকুরীও হারাতে হয়েছে বলে জানাগেছে। শুধু তাই নয়, যানজনের কারণে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম উপার্জন হওয়ায় সংসার চালানো তো দূরের কথা মালিকদের হাতে গাড়ীর জমা দিতেই হিমশিম খেতে হতো অটো রিকশা ও মিশুকসহ পরিবহন শ্রমিকদের।
এসব সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা সিটি কর্পোরেশনের সাথে বার বার আলোচনা করেও তেমন কোন সমাধানে পৌছতে পারেন নি। যানজট নিরসনের জন্য সিটি কর্পোরেশন থেকে যে ক’জন কমিউনিটি পুলিশ দিয়েছিলো, তা ছিলো নিতান্তই অপ্রতুল। ফলে জনবল কম থাকায় এ সড়কে যানজট ও বিশৃঙ্খলতা লেগেই থাকতো।
চলতি বছরে এ সমস্যা সমাধানে আরও একবার পরিবহন শ্রমিকরা মালিকদের সাথে আলোচনায় বসে। সু-প্রসন্ন এ আলোচনায় পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা সিদ্ধান্ত নেয়, তারা নিজস্ব উদ্যোগে এ সড়কে আরও কিছু লাইনম্যান নিয়োগ দিবে, যারা সিটি কর্পোরেশনের কমিউনিটি পুলিশের সাথে সমন্বিতভাবে কাজ করবে। তবে প্রশ্ন হলো, এ লাইনম্যানদের বেতন কে দিবে? তারা এ বিষয়েও আলোচনা করে সমাধান দেন। শ্রমিকরা দাবি করেন, যদি প্রতি মাসে এই লাইনম্যানদের বেতন দেয়া হয়, তাহলে সবার জন্য একটু চাপ পড়ে যাবে। আর যদি ওই মাসিক বেতনকে ভেঙ্গে প্রতিদিন করা হয়, তাহলে তাদের জন্য এটা সহজ হয়। শ্রমিকদের এ দাবির প্রেক্ষিতে মালিকরাও সম্মতি দেন।
পরে তাদের যৌথ উদ্যোগ ও অর্থায়নে প্রায় ৪ জন লাইনম্যান নিয়োগ দেয় সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য। অবশেষে আলোর মুখ দেখে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের এ উদ্যোগ। বর্তমানে এ সড়কে যানজটের সংখ্যা পূর্বের যে কোন সময়ের তুলনায় অনেক কম।
বর্তমানে এ সড়কে লাইনম্যান হিসেবে কাজ করছেন মো: সোহেল, মো: বিপ্লব ও সেলিমরা। এ লাইনম্যানরা, রোদ-বৃষ্টি, ঝড়, ধুলোবালি আর শব্দদূষণকে উপেক্ষা করে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর কাজ করে যাচ্ছেন। দিনরাত রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে নিজেদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে দেখা গেছে এসকল লাইনম্যানদের। তবে এ সড়কে শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণেও আছে নানা বিড়ম্বনা। গাড়িচালক ও পথচারীদের বেশির ভাগেরই রয়েছে আইন না মানার প্রবণতা। আইন মানাতে গেলেই নানা ধরনের হুমকি-ধমকির মুখোমুখি হতে হচ্ছে তাদের। তাদের বিরুদ্ধে অনেক সময় নানা অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্রও হয়ে থাকে। তবে এসব সামাল দিয়েই দায়িত্ব পালন করেন তারা।
বর্তমান সড়কের পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেন সুমন নামে এক যাত্রী। তিনি যাচ্ছিলেন ভোলাইল মিষ্টি দোকান এলাকায়, সেখান থেকে তিনি আবার যাবেন নিজ গ্রাম বক্তাবলীতে। তিনি বলেন, কি বলবো ভাই। এ রুটে চলাচল করতে গিয়া আগেতো জীবন যাইতো আর আইতো। ওইযে, সামনে চার রাস্তার মোড়ে যেই জ্যাম লাগতো। আমিতো বেশিরভাগ সময় অটো ফালাইয়্যা হাইটা আইসা পড়তাম। এহন কিছুডা ভালোই, জ্যাম-ট্যাম কমই লাগে। এভাবে চললেই ভালা।
বিসিকে এক গার্মেন্টসে চাকুরী করে মোসাম্মদ ইমা নামে এক নারী। এ বিষয়ে তিনি স্বস্তি প্রকাশ করে বলেন, যানজটের কারণে আগে প্রতিদিন ১০-১৫ মিনিট দেরি হতো গার্মেন্টসে যেতে। প্রতিদিন লেট হওয়ার কারণে আগের চাকুরী হারাইছি। এখন নতুন চাকুরীতে জয়েন্ট করেছি। আগের থেকে এখন যানজট অনেকটাই কম। তাই ঠিক সময়েই অফিসে হাজির হতে পারি। এখন আর স্যারদের বকা শুনতে হয় না।
এ বিষয়ে অটো চালক মো: আবেদ হোসেন বলেন, যানজটতো আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। আমরা (অটো চালকরা) নিজেরা এ রুটে লাইনম্যান রাখার কারণে এখন কিছুটা যানজট কমেছে। এর আগেতো এ রুটে যানজটের অবস্থা ভয়াবহ ছিলো। যানজটের কারণে সারাদিনে তো ঠিকঠাক মত টিপও মারতে পারতাম না। সারাদিন গাড়ী চালিয়ে মালিককে গাড়ীর জমা দিয়ে দেখতাম আমার কাছে কিছুই নেই। দুইটা বাচ্চা স্কুলে পড়ে, বাসা ভাড়া ও সংসার খরচ নিয়ে পুরো বিপদের মধ্যে ছিলাম কয়েকটা বছর। আল্লাহ্’র রহমতে সোহেল, বিপ্লব ও সেলিমরা দাঁড়ানোর পর থেকে এখন মালিককে গাড়ীর টাকা জমা দিয়েও কিছু টাকা বাসার নিতে পারি। এখন মোটামুটি ভালই আছি।
অটোচালক আসাদুল বলেন, এ রুটে যারা লাইনম্যান আছে, তাদেরকে আমরা বার বার অনুরোধ করার পরও তারা দাঁড়াতে চায়নি। এক পর্যায়ে আমরা ও অটো মালিকরা মিলে জোর করে তাদেরকে দাঁড় করিয়েছি। কিন্তু এখন দেখছি তাদের নামে বিভিন্ন অপপ্রচার করা হচ্ছে। তারা নাকি চাঁদাবাজী করে। আমি বুঝলাম না। তারা কেমন করে চাঁদাবাজ হইলো? আমরা নিজেরাই তো তাদেরকে দৈনিক একটা বেতন হিসেবে দাঁড় করিয়েছি। এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনসহ বিভিন্ন দপ্তরেও আমরা লিখিত আবেদন দিয়েছি। সেই আবেদনপত্রে আমি সহ আমাদের সকল অটোচালকদের স্মাক্ষরও রয়েছে। যারা এ অপপ্রচার চালাচ্ছে, তারা আসলে চায় না এ রুটটি যানজট মুক্ত থাকুক, শৃঙ্খলা থাকুক। তাদের প্রতি আমাদের অনুরোধ থাকবে, দয়া করে আমাদের মত নিরিহ অটোচালকদের পেতে লাথি দিবেন না। আমরা ৮-১০ জনের মতই স্ত্রী সন্তানাদি নিয়ে সুখে শান্তিতে থাকতে চাই।
চুনকা সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে রোদ-বৃষ্টিতেও ব্যস্ত তারা, স্বস্তিতে লাখো মা
