সোজা সাপটা রিপোর্ট: আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় ভূমিহীন-গৃহহীনদের আবাসনের লক্ষ্যে সিটি কর্পোরেশন এলাকায় প্রকল্প গ্রহণ করা নিয়ে মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন ও জেলা প্রশাসন। নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের কদম রসুল অঞ্চলের ২৫নং ওয়ার্ডে আশ্রয়ন প্রকল্পের স্থান নির্ধারণ করেছে জেলা প্রশাসন।
এদিকে, পরিকল্পিত নগরায়নের স্বার্থে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের অভ্যন্তরে আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় ভূমিহীন-গৃহহীনদের আবাসনের লক্ষ্যে নতুন প্রকল্প গ্রহণ না করার আবেদন জানানো হয় সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে। এর আগে, একই দাবি জানিয়ে গত ২১ জনু স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বরাবর চিঠি পাঠায় মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী।
মন্ত্রী বরাবর পাঠানো চিঠিতে মেয়র বলেন, নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন রাজধানীর অতি সন্নিকটে শিল্পঘন ও জনবহুল নগরী। এ নগরীতে প্রায় ২০ লক্ষাধিক নাগরিকের বসবাস। জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় নগরবাসীর চাহিদার প্রতি সম্মান রেখে অধিকতর সেবা নিশ্চিতকরণের লক্ষে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন বিভিন্ন ওয়ার্ডে উন্মুক্ত পার্ক, শিশুদের জন্য বিনোদন কেন্দ্র, খেলার মাঠসহ অন্যান্য বিনোদনমূলক প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে যে বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ নির্দেশনা রয়েছে।
এছাড়া মানসম্মত নাগরিক সেবা প্রদানের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহ কর্তৃক শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের লক্ষ্যে শিশুবান্ধব সেবা প্রদান, শিশুদের জন্য পার্ক ও বিনোদন কেন্দ্র নির্মাণের নির্দেশনা প্রদান করে স্থানীয় সরকার বিভাগ হতে পরিপত্র জারি করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক এ সকল (বিনোদন কেন্দ্র, খেলার মাঠ, উন্মুক্ত পার্ক ও ওয়াকওয়ে নির্মাণ) প্রকল্প গ্রহণের যথেষ্ঠ সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও প্রতিটি ওয়ার্ডে সিটির মালিকানাধীন পর্যাপ্ত ভূমি না থাকায় বর্ণিত প্রকল্পসমূহ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না।
উল্লেখ্য, নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন এলাকাটি রাজধানী ঢাকার পার্শ্ববর্তী হওয়ায় এবং শিল্প ও বাণিজ্যিক নগরী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় এখানে প্রতিনিয়ত চাকুরি, ব্যবসা সহ নানাবিধ কারনে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের জনসাধারনের সমাগম ঘটছে এবং তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। লক্ষ্য করা যাচ্ছে, সিটি কর্পোরেশন এর আওতাধীন এলাকায় আপনার মালিকানাধীন খাস খতিয়ানভুক্ত ভূমিতে ভূমিহীন-গৃহহীনদের আবাসনের লক্ষ্যে নতুন নতুন প্রকল্প গ্রহণ করে স্থায়ী আবাসনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। নতুন আবাসনের কারনে নগরীর উপরে বাড়তি চাপ তৈরি হবে। ফলে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক নাগরিক সেবা নিশ্চিত করনে দূরূহ হয়ে পড়বে।
সিটি কর্পোরেশনের সীমানার বাইরে সরকারি খাস খতিয়ানভুক্ত পর্যাপ্ত খালি জায়গা রয়েছে, যেখানে নতুন নতুন প্রকল্প গ্রহণ করে ভূমিহীন-গৃহহীনদের আবাসনের ব্যবস্থ করা যেতে পারে মর্মে প্রতিয়মান হয়। এত নগরীর উপর সৃষ্ট চাপ যেমন হ্রাস পাবে তেমনি পরিবেশ সুরক্ষাসহ পরিকল্পিত নগরায়নের পথ সুগম হবে।
এমতাবস্থায়, পরিবেশ ও প্রতিবেশগত ভারসাম্য ও সুরক্ষাসহ টেকসই পরিকল্পিত নগরায়ন এবং জলসবুজের নগরী গড়ে তোলার লক্ষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন ও স্থানীয় সরকার বিভাগের পরিপত্র বাস্তবায়নে সিটি কর্পোরেশন এলাকার অভ্যন্তরে বিদ্যমান খালি জায়গা সমূহে জনস্বার্থে আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় ভূমিহীন-গৃহহীনদের আবাসনের লক্ষ্যে নতুন প্রকল্প গ্রহণ না করার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হল।
চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, গত বছরের ২৪ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসককে পত্র দেয়া হলেও ২৫নং ওয়ার্ডে সিটি কর্পোরেশনের কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পের অভ্যন্তরে ভূমিহীন-গৃহহীনদের আবাসনের জন্য ঘর নির্মাণের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। নদীর তীর ভূমিতে বৃক্ষরোপনসহ ওয়াকওয়ে ও প্যাভমেন্ট নির্মাণের পরিবর্তে জনবসতি স্থাপনের পদক্ষেপ মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের রায়সহ অন্যান্য নির্দেশনা ও সিদ্ধান্তের পরিপন্থী। উল্লেখ্য, অকৃষি খাস জমি বন্দোবস্ত ও ব্যবস্থাপনা নীতিমালা ১৯৯৫ অনুযায়ী সিটি কর্পোরেশন এলাকার সকল খাস জমিই অকৃষি খাস জমি।
সাধারনত: আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে ভূমিহীনদের কৃষি খাস জমি বন্দোবস্ত দিয়ে পূর্নবাসন করা হয়। ইউনিয়নভুক্ত এলাকায় কৃষি খাস জমি থাকা সত্ত্বেও সিটি কর্পোরেশনের অভ্যন্তরে নদীর তীরবর্তী ভূমিতে গৃহনির্মানের পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে, যা অনভিপ্রেত।
এমতাবস্থায়, পরিকল্পিত নগরী গড়ে তোলার লক্ষ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন ও স্থানীয় সরকার বিভাগের পরিপত্র এবং মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের রীট পিটিশনের রায়ের নির্দেশনা মোতাবেক সিটি কর্পোরেশন এলাকার অভ্যন্তরে নদীর তীরবর্তী জায়গা সমূহে বিনোদন কেন্দ্র, খেলার মাঠ, উন্মুক্ত পার্ক, ওয়াকওয়ে ও প্যাভমেন্ট নির্মাণে স্বার্থে জেলা প্রশাসন কর্তৃক সিটি কর্পোরেশনের অভ্যন্তরে নতুন প্রকল্প গ্রহণ না করে সিটির বাহিরে ইউনিয়নভূক্ত এলাকায় সরকারি খাস জমিতে আশ্রয়ন প্রকল্প গ্রহণ করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা প্রদানের জন্য সবিনয় অনুরোধ করা হলো।
এদিকে, চিঠির বিষয়ে মন্ত্রনালয় থেকে কোনো বক্তব্য না আসলেও সেই জায়গায় আশ্রয়ন প্রকল্পের কাজ চলমান রাখে জেলা প্রশাসন। গত মঙ্গলবার জায়গা পরিমাপ করতে যাওয়ার সাথে সাথেই মেয়র আইভী তাতে আপত্তি জানিয়ে কাজ স্থগিত রাখে।
জানা যায়, ১১ জুলাই মঙ্গলবার দুপুরে বন্দরের লক্ষণখোলা এলাকায় নদীর তীরবর্তী ভূমিতে আশ্রয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে জমির পরিমাপ কাজ শুরু করে প্রশাসন। উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) উপস্থিতিতে কাজ চালায় প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তবে সেখানে আশ্রয়ন প্রকল্প না করতে আগে থেকেই নিজেদের মতামত জানিয়েছিলো নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন। মাপ-ঝোপের কাজ শুরু হতেই স্থানীয় কাউন্সিলর এনায়েত হোসেন উপস্থিত হয়ে মেয়র আইভীর নির্দেশে এই কাজে আপত্তি জানায়। পরে প্রশাসনের লোকজন সেখান থেকে সরে আসেন।
অপরদিকে, মেয়রের পক্ষে উপস্থিত হয়ে কাজে বাধা প্রদানের পরে কাউন্সিলরকে ফোন করে গ্রেপ্তার করার কথা বলেছেন বলে জানান ২৫ নম্বর ওয়ার্ড, কাউন্সিলর এনায়েত হোসেন। তিনি বলেন, ‘মেয়রের নির্দেশে আশ্রয়ন কাজে আপত্তি তোলার পর কাজ করতে আসা ব্যক্তিরা চলে যায়। এর কিছু সময় পরেই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিএম কুদরত এ খুদা আমাকে ফোন করে বলে এটা সরকারি কাজ, কেন বাধা দেয়া হলো? সরকারি কাজে বাধা আসলে প্রয়োজনে এরেস্ট করা হতে পারে।
এদিকে খেলার মাঠে আশ্রয়ন প্রকল্পের কাজ শুরুর বিষয়ে জেলা প্রশাসক মঞ্জুরুল হাফিজ বলেন, ‘ওই স্থানে আশ্রয়ন প্রকল্পের ঘর করা প্রয়োজন। কিন্তু শুনতে পেলাম সেখানে নাকি বাচ্চারা খেলাধুলা করে। প্রকৃতপক্ষে সেখানে গরুর হাট করার জন্য জায়গা ভরাট করা হয়েছিলো। গরুর হাট করতে দেইনি কারণ জায়গা জেলা প্রশাসনের। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ঘর করার জন্য আমরা জায়গা খুজছি। আমরা বুধবার ভিজিটে যাব, যদি সেখানে করা যায় তাহলে সেখানে ঘর করবো, নাহলে পাশে কোথাও করবো।"
ইউনিয়ন পরিষদ এলাকায় ঘর নির্মাণ প্রস্তাবের বিষয়ে বলেন, 'গৃহহীন যদি সিটি করপোরেশন এলাকায় থাকে এবং আমাদের যদি সেখানে জায়গা থাকে, তাহলে আমরা আমাদের জায়গায় প্রকল্প বাস্তবায়ন করবো। আমরা তো সিটি করপোরেশনের জায়গা নিবো না, এটা সরকারি জায়গা। তবে খেলার মাঠকে আমরা সম্মান করি, বাচ্চাদের জন্য খেলার মাঠ দরকার। খেলার মাঠ অক্ষত রেখে কিভাবে কাজ করা যায় সেটা আমরা দেখবো।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেন, ‘সিটি করপোরেশন এলাকায় খেলার মাঠের সংকট। সেখানে বাচ্চাদের খেলার মাঠে আশ্রয়ন প্রকল্প কেন করতে হবে? তাছাড়া নদী তীরবর্তী ভূমিতে স্থাপনা নির্মাণ না করতে হাইকোর্টের রায় আছে। সেখানে ইকোপার্ক, বৃক্ষরোপন, খেলার মাঠ তৈরী করতে সংশ্লিষ্ট পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনকে নির্দেশ দেয়া আছে। আমরা বলছি, সিটি করপোরেশনের পাশেই ইউনিয়ন পরিষদ এলাকায় পর্যাপ্ত খালি জায়গা রয়েছে। সেখানে যেন এই আশ্রয়ন প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন করা হয়।